ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নাসিরাবাদ কলেজের গভর্নিং বডির কমিটি নিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য মুহিত উর রহমান শান্ত ও আওয়ামী লীগ নেতা আমিনুল হক শামীমের (সিআইপি) মধ্যে দ্বন্দ্ব চরমে।
অভিযোগ উঠেছে, মোহিত উর রহমান শান্ত নিজের এমপি পদ কাজে লাগিয়ে কলেজটিতে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। এজন্য তিনি নিয়ম বহির্ভূতভাবে নিজের আস্থাভাজন ব্যক্তিকে কলেজের পরিচালনা কমিটির সভাপতি নির্বাচনের জন্য অধ্যক্ষ আহমেদ শফিক বরাবর আধা সরকারি পত্র (ডিও-লেটার) দিয়েছেন। বিষয়টি শিক্ষার্থীদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। এ নিয়ে তারা মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করছেন।
এসব অনিয়ম রোধে কলেজের বিগত গভর্নিং বডির সভাপতি আমিনুল হক শামীম জনস্বার্থে উচ্চ আদালতে একটি রিট করেছেন। রিটের ওপর শুনানি নিয়ে গত ২৯ এপ্রিল বিচারক মো. খাসরুজ্জামান ও কে এম জাহিদ সারওয়ারের আদালত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঘোষিত গভর্নিং বডি কমিটির কার্যকারিতার ওপর স্টে অর্ডার জারি করেন।
জানা যায়, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ময়মনসিংহ-৪ (সদর) আসন থেকে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে বিজয়ী হন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুহিত উর রহমান শান্ত। ওই নির্বাচনে ট্রাক প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়েন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আমিনুল হক শামীম (সিআইপি)। তখন থেকেই এ দুই আওয়ামী লীগ নেতার বিরোধ প্রকাশ্যে আসে। তাদের দ্বন্দ্বের প্রভাব পড়ে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও।
মুহিত উর রহমান শান্ত ময়মনসিংহ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক ধর্মমন্ত্রী প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমানের ছেলে। অন্যদিকে, আমিনুল হক শামীম ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সাবেক সহ-সভাপতি। তার ছোট ভাই ইকরামুল হক টিটু ময়মনসিংহ মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের বর্তমান মেয়র।
সূত্র জানায়, গত ২৪ এপ্রিল দুপুরে নাসিরাবাদ কলেজের শিক্ষার্থীরা সাধারণ শিক্ষার্থীর ব্যানারে গভর্নিং বডিতে বিতর্কিত ব্যক্তির অন্তর্ভুক্তির প্রতিবাদে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেন। এরপরই গভর্নিং বডির অনিয়মের বিষয়টি সামনে আসে এবং শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা।
শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করায় গত ৩০ এপ্রিল নাসিরাবাদ কলেজের অধ্যক্ষের সঙ্গে অপ্রীতিকর আচরণের ঘটনা ঘটে বলে জানা গেছে। এমনকি তাকে হুমকি-ধমকি দেওয়ার মতো পরিবেশও তৈরি করা হয়েছিল বলে জানা গেছে।
ওইদিনই অধ্যক্ষ আহমেদ শফিক বাদী হয়ে কোতোয়ালী মডেল থানায় নাসিরাবাদ কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক জিএস ও জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আখেরুল ইমাম সোহাগসহ অজ্ঞাতনামা ৪-৫ জনকে অভিযুক্ত করে সাধারণ ডায়েরি করেন।
জানা যায়, এমপি মোহিত উর রহমান শান্ত জাতীয় সংসদের প্যাডে দেওয়া ডিও লেটারে ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ফারুক আহমেদ খানকে কলেজের পরিচালনা কমিটির সভাপতি করার জন্য সুপারিশ করেছেন। যা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের পরিপন্থি।
গত ১৪ মার্চ দেওয়া ওই ডিও লেটারে তিনি উল্লেখ করেছেন, তার বাবা সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান এ কলেজে নিজের শিক্ষকতা জীবন শুরু করেছিলেন। এ কলেজের সঙ্গে তার পরিবারের অসংখ্য স্মৃতি জড়িত ও কলেজটির উন্নয়নে তার বাবার অবদান রয়েছে। এ অবস্থায় তিনি কলেজটির গভর্নিং বডিতে নিজের পছন্দের লোককে সভাপতি হিসেবে মনোনীত করতে চান।
২০২১ সালের ৩ জুন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজে গভর্নিং বডির নির্বাচন পদ্ধতি সম্পর্কিত এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ/শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের গভর্নিং বডি (সংশোধিত) সংবিধি -২০১৯ এর ধারা -২৭ অনুযায়ী গভর্নিং বডির মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস পূর্বে বিভিন্ন ক্যাটাগরি যেমন, শিক্ষক, অভিভাবক, প্রতিষ্ঠাতা, দাতা এবং হিতৈষী প্রতিনিধি নির্বাচনের নিমিত্তে গভর্নিং বডির সভায় তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে।
উক্ত কমিশনের তিনজন সদস্য হবেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক মনোনীত গভর্নিং বডির বিদ্যোৎসাহী সদস্য, গভর্নিং বডি কর্তৃক মনোনীত এমন একজন শিক্ষক, যিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন না এবং অধ্যক্ষ, যিনি রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
গভর্নিং বডি গঠনের লক্ষ্যে উল্লেখিত বিধি মোতাবেক নির্বাচন কমিশন গঠন করে এ সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে। অন্যথায় কমিটি গঠনের আবেদন বিবেচনা করা হবে না বলে ওই প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা আছে।
এদিকে, গত ২১ এপ্রিল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শক (ভারপ্রাপ্ত) ফাহিমা সুলতানার সই করা এক চিঠিতে নাসিরাবাদ কলেজের পরিচালনা কমিটির সভাপতি করা হয় জেলা প্রশাসককে। একই সঙ্গে এমপির আস্থাভাজন হিসেবে তিনি যাকে সভাপতি মনোনীত করার জন্য ডিও লেটার দিয়েছেন তাকে বিদ্যোৎসাহী সদস্য করা হয়। তিনি হলেন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও হালুয়াঘাট উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ খান।
আগের কমিটির মেয়াদ ২২ এপ্রিল শেষ হলে ২৩ এপ্রিল থেকে নতুন কমিটির কার্যকারিতা শুরু হয়। সভাপতি ও বিদ্যোৎসাহী সদস্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নির্বাচিত করে দিলেও কমিটির অন্যান্য সদস্য স্থানীয়ভাবেই নির্বাচিত হন। তফসিল অনুযায়ী চলতি বছরের গত ১৬ ফেব্রুয়ারি অভিভাবক প্রতিনিধি নির্বাচনের দিন নির্ধারিত ছিল।
বিগত কমিটিতে সভাপতি ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সহ-সভাপতি আমিনুল হক শামীম ও বিদ্যোৎসাহী সদস্য ছিলেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক ড. মোল্লাহ আমিনুল ইসলাম।
নতুন সভাপতি ও বিদ্যোৎসাহী সদস্য নির্বাচনের জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষ দুটি পদে তিনজন সদস্যের নাম অন্তর্ভুক্ত করে প্রস্তাব পাঠায়। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সেই প্রস্তাবনা থেকে সভাপতি ও বিদ্যোৎসাহী সদস্য নির্বাচন করেনি বলে জানিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে অধ্যক্ষ আহমেদ শফিক জাগো নিউজকে বলেন, সভাপতি পদে আমিনুল হক শামীম (সিআইপি), মাহাবুবুর রহমান, ডা. মুহম্মদ আহসান উদ্দিন সুমন এবং বিদ্যোৎসাহী সদস্য পদে কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোল্লাহ আমিনুল ইসলাম, ড. প্রহল্লাদ চন্দ্র দাস ও বাংলাদেশ লোকশিল্প জাদুঘরের ড. আমিনুর রহমান সুলতানের নাম প্রস্তাব করা হয়। তবে, আমার প্রস্তাবিত ছয়জনের মধ্যে কাউকেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঘোষিত কমিশনে রাখা হয়।
তিনি বলেন, কমিশন ঘোষণার পর শিক্ষার্থীরা কার বা কাদের ইন্ধনে বিক্ষোভ করেছে সেটা আমার জানা নেই। তবে, শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করার চারদিন পর স্থানীয় কয়েকজন নেতাকর্মী আমার অফিস কক্ষে ঢুকে আমাকে বিভিন্ন হুমকি-ধমকি দেয়। এক পর্যায়ে আমি কক্ষ থেকে বের হয়ে যাই।
সংসদ সদস্য মুহিত উর রহমান শান্তর ডিও-লেটার সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এমপি সাহেব ডিও-লেটার আমাকে দিয়েছিল। কমিশনে আবেদন করতে হয় অনলাইনে, যে কারণে প্রস্তাবে ডিও-লেটার সংযুক্ত করা সম্ভব হয়নি।
জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘোষিত বিদ্যোৎসাহী সদস্য ফারুক আহমেদ খান জাগো নিউজকে বলেন, কলেজের বিদ্যোৎসাহী সদস্য পদ নিয়ে কোনোদিন আন্দোলন হয়েছে বলে শুনিনি। আমাকে বিদ্যোৎসাহী করায় কারও স্বার্থে আঘাত লেগে থাকতে পারে। তারাই হয়তো শিক্ষার্থীদের দিয়ে আন্দোলন করাচ্ছেন। তবে কে কাকে হুমকি দিয়েছে সে বিষয়টি আমার জানা নেই।
এ বিষয়ে জানতে আমিনুল হক শামীমের মোবাইল ফোন নম্বরে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
শামীমের পক্ষে রিট আবেদন দায়ের করা সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. বদরুদ্দোজা জাগো নিউজকে বলেন, রিটটি আদালত আমলে নিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঘোষিত কমিটির ওপর স্টে অর্ডার জারি করেছেন।
বিষয়টি নিয়ে জানতে সংসদ সদস্য মুহিত উর রহমান শান্তর মোবাইল ফোন নম্বরে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও তার সঙ্গেও যোগাযোগ করা যায়নি।
কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাইন উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, নাসিরাবাদ কলেজের অধ্যক্ষ একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন। তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে নাসিরাবাদ কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি করে চিঠি দিয়েছেন। এ বিষয়ে আমার মন্তব্য করার কিছু নেই
মঞ্জুরুল ইসলাম/এমকেআর