ব্যক্তিগত অনুভব পেরিয়ে মনে হতে লাগল, কলকাতার সাংবাদিকেরা শুধুই দুই বন্ধুর অর্ধশতাধিক বছরের পর কথোপকথনে মিলিত হওয়ার এই নাটকীয় বিষয়টিকে এতটা গুরুত্ব দিলেন! রাজনৈতিক বাস্তবতাকে অবহেলে, ধর্ম পরিচয়ের হিন্দু-মুসলমানত্ব পাশে সরিয়ে বাঙালির যে ভাষাভিত্তিক সংস্কৃতি-উৎসারিত একটি সুগভীর শিকড় আছে, তার এক স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটেছে তাদের প্রতিবেদনে, কাঁটাতার ওপার-এপার তারই প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করে। মনে পড়ে গেল, আমাদের মায়েদের কথা। আহা, তিনজনের কেউ-ই বেঁচে নেই আজ। অন্য বাড়িতে গিয়ে তিনজনই দুজনকে ‘মাসি’ বলে ডাকতাম। কিন্তু এই পড়ন্ত বেলায় অনুভব করি, তিন মায়ের কাছে ছেলে ছিলাম আমরা; সন্তানতুল্য উল্লেখ করলে পুরো সত্যটা ধরা যাবে না। কত সব স্মৃতি উথলে ওঠে, ১৯৬৪ সালের শেক্সপিয়ারের ৪০০ বছর উদ্যাপন, অপটু নাট্যাভিনয়, কিন্তু অনিরুদ্ধ উৎসাহ, প্রফেসর ঘোষাল জুলিয়াস সিজার পাঠদানের সময় ‘এত তু, ব্রুতে’ সংলাপ বলে স্যুট-টাই পরে মেঝেতে পড়ে গেলেন, শিক্ষক ও খ্যাতনামা অভিনেত্রী কেয়া চক্রবর্তীর শিক্ষকতা জীবনের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলাম আমরা, কী ঘনিষ্ঠ হয়ে মিলতেন, নাটকের প্রতি আমার আলাদা ঝোঁক দেখে কয়েক দিন পরে আমাকে আর অন্য কয়েকজনকে ‘তুই’ বলা শুরু করলেন, কফি হাউসের আড্ডায় একটুও আর মাস্টারনি থাকতেন না। হারিয়ে গেছে সেই সব দিন।
অনেক দিনের আমাদের এসব গান সুদীর্ঘ বিরতিতে জলছাপের অস্পষ্টতা ছাড়িয়ে পুনর্জন্ম লাভ করেছিল গত ২০ জানুয়ারি কলকাতা বইমেলা প্রাঙ্গণে, ওই হ্যাম রেডিওর সৌজন্যে। আমার সঙ্গে একই উড়ালে ছিলেন ঢাকার শামসুল হুদা। কুয়াশার জন্য উড়ালে সাড়ে তিন ঘণ্টার বিলম্ব। ঢাকা বিমানবন্দর লাউঞ্জ থেকেই গৌতমের সঙ্গে কথা হলো। বেলা তিনটায় মেলার মাঠে ঢুকব, তার অনেক আগেই ওরা অপেক্ষমাণ। কলকাতার অনেক সাংবাদিক। সঙ্গে ঢাকার নিউজ চ্যানেলের কয়েকজন। ঢাকা থেকে আমিই স্থান নির্বাচন করে দিয়েছিলাম। মূল মিলনায়তনের ঠিক পেছনে। কী সুন্দর কাকতালীয় যোগ। উল্টো দিকের একটি প্যাভিলিয়নের দেয়ালে লেখা—‘ভালোবাসা নিয়ো কলকাতা’। শিশুদের মতো দৌড় দিয়ে পরস্পরের আলিঙ্গন ও প্রায় উদ্দাম নৃত্য। এই বার্তা রটে গেছে মেলার চারদিকে। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে উত্তেজিত আমরা।